Type Here to Get Search Results !

আর্কিমিডিস [২৮৭–২১২খৃষ্ট পূর্ব]

আর্কিমিডিস [২৮৭–২১২খৃষ্ট পূর্ব]

সাইরাকিউসের সম্রাট হিয়েরো এক স্বর্ণকারকে দিয়ে একটি সোনার মুকুট তৈরি করেছিলেন। মুকুটটি হাতে পাওয়ার পর সম্রাটের মনে হল এর মধ্যে খাদ মিশানো আছে। কিন্তু স্বর্ণকার খাদের কথা অস্বীকার করল। কিন্তু সম্রাটের মনের সন্দেহ দূর হল না। তিনি প্রকৃত সত্য নিরূপণের ভার দিলেন রাজদরবারের বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের উপর।

মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন আর্কিমিডিস। সম্রাটের আদেশে মুকুটের কোন ক্ষতি করা যাবে না। আর্কিমিডিস ভেবে পান না মুকুট না ভেঙে কেমন করে তার খাদ নির্ণয় করবেন। কয়েকদিন কেটে গেল। ক্রমশই অস্থির হয়ে ওঠেন আর্কিমিডিস। একদিন দুপুরবেলায় মুকুটের কথা ভাবতে ভাবতে সমস্ত পোশাক খুলে চৌবাচ্চায় স্নান করতে নেমেছেন। পানিতে শরীর ডুবতেই আর্কিমিডিস লক্ষ্য করলেন কিছুটা পানি চৌবাচ্চা থেকে উপছে পড়ল। মুহূর্তে তাঁর মাথায় এক নতুন চিন্তার উন্মেষ হল। এক লাফে চৌবাচ্চা থেকে উঠে পড়লেন। তিনি ভুলে গেলেন তাঁর শরীরে কোন পোশাক নেই। সমস্যা সমাধানের আনন্দের নগ্ন অবস্থাতেই ছুটে গেলেন রাজ দরবারে।

মুকুটের সমান ওজনের সোনা নিলেন। একপাত্র পানিতে মুকুটটি ডোবালেন। দেখা গেল খানিকটা পানি উপছে পড়ল। এইবার মুকুটের ওজনের সমান সোনা নিয়ে জলপূর্ণ পাত্রে ডোবানো হল। যে পরিমাণ পানি উপছে পড়ল তা ওজন করে দেখা গেল আগের উপছে পড়া পানি থেকে তার ওজন আলাদা। আর্কিমিডিস বললেন, মুকুটে খাদ মেশানো আছে। কারণ যদি মুকুট সম্পূর্ণ সোনার হত তবে দুটি ক্ষেত্রেই উপছে পড়া পানির ওজন সমান হত।

Archimedes in his bath
Archimedes in his bath


এই আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হল একটি বৈজ্ঞানিক সূত্র।তরল পদার্থের মধ্যে কোন বস্তু নিমজ্জিত করলে সেই বস্তু কিছু পরিমাণে ওজন হারায়। বস্তু যে পরিমাণে ওজন হারায় সেই পরিমাণ ওজন বস্তুর অপসারিত তরল পদার্থের ওজনের সমান।এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আর্কিমিডিসের সূত নামে বিখ্যাত।

আর্কিমিডিসের জন্ম আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ২৮৭ সালে। সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত সাইরাকিউস দ্বীপে। পিতা ফেইদিয়াস ছিলেন একজন জ্যোতির্বিদ।

কৈশোর যৌবনে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে পড়াশুনা করেছেন। সেই সময় আলেকজান্দ্রিয়া ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পীঠস্থান। ছাত্র অবস্থাতেই আর্কিমিডিস তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা সুমধুর ব্যক্তিত্বের জন্য সর্বজন পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর গুরু ছিলেন ক্যানন। ক্যানন ছিলেন জ্যামিতির জনক মহান ইউক্লিডের ছাত্র। পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি চেয়েছিলেন গণিতবিদ হবেন। অঙ্কশাস্ত্র, বিশেষ করে জ্যামিতিতে তাঁর আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। ইউক্লিড, ক্যানন যেখানে তাঁদের বিষয় সমাপ্ত করেছিলেন আর্কিমিডিস সেখান থেকেই তাঁর কাজ আরম্ভ করেন। আর্কিমিডিস যুদ্ধকে ঘৃণা করতেন। কারো আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করাও তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। কিন্তু যেহেতু তিনি ছিলেন সাইরাকিউসের প্রজা, সম্রাট হিয়েরার রাজকর্মচারী তাই নিরুপায় হয়েই তাঁকে সম্রাটের আদেশ মেনে চলতে হত।

সম্রাটের আদেশেই তিনি প্রায় ৪০ টি আবিষ্কার করেন। তার মধ্যে কিছু ব্যবসায়ীকে জিনিস হলেও অধিকাংশই ছিল সামরিক বিভাগের প্রয়োজন।

আর্কিমিডিসের একটি আবিষ্কার পুল লিভার। একবার কোন একটি জাহাজ চরায় এমনভাবে আটকে গিয়েছিল যে তাকে আর কোনভাবেই পানিতে ভাসানো সম্ভব হচ্ছিল না। আর্কিমিডিস ভালভাবে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলেন। তাঁর মনে হল একমাত্র যদি এই জাহাজটাকে উঁচু করে তোলা যায় তবেই জাহাজটাকে পানিতে ভাসান সম্ভব। আর্কিমিডিসের কথা শুনে সকলে হেসেই উড়িয়ে দিল।

অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই উদ্ভাবন করলেন লিভার আর পুলি। জাহাজ ঘাটে এটা উঁচু জায়গার লিভার খাটাবার ব্যবস্থা করলেন। তার মধ্যে বিরাট একটা দড়ি বেঁধে দিলেন। দড়ির একটা প্রান্ত জাহাজের সঙ্গে আষ্টে-পিষ্টে বাঁধা হল। এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে সম্রাট হিয়েরো নিজেই এলেন জাহাজ ঘাটায়। নগর ভেঙে যেখানে যত মানুষ ছিল সকলে জড় হয়েছে। আর্কিমিডিস সম্রাটকে অনুরোধ করলেন লিভার লাগানো দড়ির আরেকটা প্রান্ত ধরে টানতে। আর্কিমিডিসের কথায় সম্রাট তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়িটা ধরে টান দিলেন। সাথে সাথে অবাক কাণ্ড। নড়ে উঠল জাহাজটা। চারদিকে চিৎকার উঠল। এবার সম্রাটের সাথে দড়িতে হাত লাগালেন আরো অনেকে। সকলে মিলে টান দিতেই সত্যি সত্যি জাহাজ শূন্যে উঠতে আরম্ভ করল। সম্রাট আনন্দে বুকে জুড়িয়ে ধরলেন আর্কিমিডিসকে।

এই আবিষ্কারের ফলে বড় বড় পাথর, ভারী জিনিস, কুয়া থেকে জল তোলার কাজ সহজ হল। একবার আর্কিমিডিস গর্ব করে বলেছিলেন, আমি যদি পৃথিবীর বাইরে দাঁড়াবার একটু জায়গা পেতাম তবে আমি আমার এই লিভার পুলির সাহায়ে পৃথিবীটাকেই নাড়িয়ে দিতাম।

রোমান সেনাপতি মার্কিউলাস সাইরাকিউস আক্রমনের জন্য বিরাট নৌবাহিনী নিয়ে রওনা হলেন।

রোমান সেনাপতি সাইবাকিউস দখল করে নেন। মার্কিউলাস আদেশ দিলেছিলেন আর্কিমিডিসকে যেন হত্যা না করা হয়। তাঁকে সসম্মানে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হয় কারণ তিনি সচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন সেই মহান বিজ্ঞানীকে যিনি একাই তাঁর বিশাল বাহিনীকে প্রতিহত করেছিলেন।

কিন্তু সৈনিকদের কেউই আর্কিমিডিসকে চিনত না। তারা সমস্ত নগরময় অনুসন্ধান করতে আরম্ভ করল। আত্মভোলা আর্কিমিডিস তখন আপন মনে গবেষণার কাজ করে চলেছেন। শত্রুপক্ষের যুদ্ধ জয়ের কোন সংবাদই তিনি রাখেন না। খোঁজ করতে করতে একজন সৈন্য দেখতে পেল এক বৃদ্ধ, সারা মুখে সাদা দাড়ি। নিজের কুটিরের সামনে বসে আপনমনে চক খড়ি দিয়ে মেঝের উপর বৃত্ত আঁকছে।

সৈনিকটি বলে উঠল, তুমি আমার সঙ্গে চল, আমাদের সেনাপতি তোমার খোঁজ করছেন।

বৃদ্ধ আর্কিমিডিস বলে উঠলেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যেতে পারব না।

ধরণের কথা শোনবার জন্য প্রস্তুত ছিল না রোমান সৈন্যটি। তাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে তা পালন করতেই হবে। আর্কিমিডিসের হাত ধরতেই এক টানে ছাড়িয়ে নিলেন আর্কিমিডিস।

আমার কাজ শেষ না হলে কোথাও যেত পারব না।

আর সহ্য করতে পারল না সৈনিক। পরাজিত দেশের এক নাগরিকের এতদূর স্পর্ধা, তার হুকুম অগ্রাহ্য করে! একটানে কোমরের তলোয়ার বার করে ছিন্ন করল মহা বিজ্ঞানীর দেহ। রক্তের ধারায় শেষ হলে গেল তাঁর অসমাপ্ত কাজ।

আর্কিমিডিসকে হত্য করা হয়েছিল সম্ভবত খ্রীস্টপূর্ব ২১২ সালে। বিজ্ঞানীর ছিন্ন মুণ্ডু দেখে গভীরভাবে দুঃখিত হয়েছিলেন মার্কিউলাস। তিনি মর্যাদার সাথে আর্কিমিডিসের দেহ সমাহিত করেন।

মহাবিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের আবিষ্কার সম্বন্ধে সঠিক কোনতথ্য জানা যায় না। সামরিক প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করলেও বিষয়ে তার কোন আগ্রহ ছিল না। মূলত গাণিতিক বিষয়েই ছিল তাঁর আগ্রহ। দিনের অধিকাংশ সময়েই তিনি গবেষণায় নিমগ্ন থাকতেন। বাইরের জগতের সব কথাই তিনি তখন ভুলে যেতেন। এমন বহু সময় গিয়েছে তাঁর কাজের লোক তাঁকে খাবার দিয়ে গিয়েছে, সারাদিনে তিনি সেই কাবার স্পর্শই করেননি। ভুলেই গিয়েছেন খাবার কথা। আবার কখনো স্নান করতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানেই কাটিয়ে দিতেন। খোঁজ করতে দেখা গেল তিনি স্নানাগারের দেওয়ালেই অঙ্ক কষে চলেছেন। বলবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতিবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর রচনার সংখ্যা বারোটি। এছাড়াও তিনি আর যে সমস্ত রচনা করেছিলেন তার কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।

গণিত সংক্রান্ত ব্যাপারে আর্কিমিডিসের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল

() বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত আবিষ্কার করেছিলেন।

() অধিবৃত্তীয় অংশগুলোর ক্ষেত্রফল নির্ধারণ করেছিলেন।

() শঙ্ককৃতি এবং গোলাকৃতি বস্তুর সম্বন্ধে ৩২ টি প্রতিজ্ঞা উদ্ভাবন করেছিলে।

() বলবিদ্যার তত্ত্বের ভীত হিসাবে সমতল ক্ষেত্রের সাম্যতা সম্বন্ধে তত্ত্ব নির্ধারণ করেন। তাঁর বহু আবিষ্কৃত সত্য আজও বিজ্ঞানীদের পথ নির্দেশ করে।


আরো পড়ুন>>

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad