ঠাকুরমার ঝুলি গল্পসমগ্র: রাজার গণক তোতা পাখি
এক শিকারি একদিন শিকারের জন্য জঙ্গলের ভেতর ঘুরতে লাগল, এমন সময় শিকারি একটি গাছের ডালে একটি সুন্দর হিরামন তোতা পাখি দেখতে পেল, সঙ্গে সঙ্গে শিকারি কাঁধ থেকে তার ধনুক নামিয়ে হিরামন তোতার দিকে তাক করল, হিরামন তোতা গাছে বসে শিকারিকে লক্ষ করছিল, সে তখন মানুষের ভাষায় কাতর স্বরে বলল—‘ওহে শিকারী, আমাকে মেরে তোমার কী লাভ? বড়জোর রান্না করে কয়েক টুকরো মাংস খেতে পারবে, তার চেয়ে বরং আমাকে এ রাজ্যের রাজার কাছে বিক্রি করে দিও, অনেক টাকা পাবে, তুমি বড়লোক হয়ে যাবে।'
শিকারি
তাচ্ছিল্য স্বরে বলল——তোমাকে নিয়ে রাজা, কত আর
দাম দেবে?' তোতা বলল—‘তুমি আমার কথা বিশ্বাস করে
দেখতে পার। আমার দামের কথা আমি নিজেই রাজাকে বলব, তোমাকে কোন কথা বলতে হবে না।'
শিকারী এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল— “ঠিক আছে তোমার কথামতই চলব। দেখি বিশ্বাসের মূল্য কতটা পাই।'
শিকারী
হিরামন তোতাকে নিয়ে রাজদরবারে উপস্থিত হল। মহারাজ পাত্রমিত্র সহ রাজদরবারে বসেছিলেন,
শিকারীর হাতে সুন্দর হিরামন পাখি দেখে মহারাজ সভাসদদের উদ্দেশ্যে বললেন— 'ভারী সুন্দর পাখি তো!’
—উপস্থিত সকলে মহারাজের কথায়
সম্মতি জানালেন।
শিকারি
মহারাজের সামনে অভিবাদন করে বললেন—'মহারাজ, আমি এই পাখিটা বিক্রি
করতে চাই।'
মহারাজ
খুশী হয়ে বললেন, ‘তা কত দিতে হবে বাপু??
শিকারী
বলল—‘মহারাজ পাখির দাম পাখি নিজের
মুখেই বলবে। আপনি অনুগ্রহ করে পাখির কাছে জেনে নিন।'
মহারাজ
শিকারির কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন, মনে মনে ভাবলেন লোকটি নিশ্চয়ই পাগল, রেগে বললেন,
মস্করা হচ্ছে, পাখি কথা বলতে পারে, এই কে আছ এই উন্মাদকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।
শিকারি
হাত জোড় করে বলল—'অপরাধ ক্ষমা করবেন মহারাজ,
অনুগ্রহ করে এই গরিবের কথা বিশ্বাস করে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখুন না?’
মহারাজ
সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে, তা হিরামন বল দেখি তোমার বিক্রয় মূল্য কত?'
—হিরামন তোতা পা তুলে প্রথমে
মহারাজকে প্রণাম জানাল তারপর বলল—'মহারাজ আমার মূল্য এক সহস্র
স্বর্ণমুদ্রা।' তোতার মুখে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে মহারাজ চমকে উঠলেন, মনে মনে ভাবলেন
শিকারি তবে তো মিথ্যা বলেনি, টাকার অঙ্কটা শুনে মহারাজ কৌতূহলী হয়ে বললেন—‘এত টাকা দিয়ে তোমাকে নিয়ে আমার লাভ
কী?’
—মহারাজ লাভ লোকসানের এখন তো
কিছুই বুঝতে পারবেন না। আগে আমাকে কিনুন তারপর না হয়, লাভ লোকসানের কথা ভাবা যাবে।
মহারাজ শিকারিকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বিদায় দিলেন।
মহারাজের
নির্দেশে হিরামন তোতার জন্য একটি সোনার খাঁচা তৈরি করা হল, খাঁচাটি মহারাজের সিংহাসনের
পাশে রাখার আদেশ দিলো। দিনে দিনে মহারাজ পাখিটিকে যত দেখছেন ততই মুগ্ধ হচ্ছেন। হিরামন
তোতা শুধু যে দেখতেই সুন্দর তা নয়, গুণও আছে অনেক, মহারাজের যখন মন খারাপ লাগত তখন
হিরামন সুন্দর সুন্দর গান গেয়ে মহারাজের মন উৎফুল্ল করে তুলতো, শাস্ত্রের কথা বলত
নানারকম উপদেশ দিত। মহারাজ ভেবে দেখলেন যে, খুবই স্বল্প মূল্যে তিনি একটি দুষ্প্রাপ্য
জিনিস সংগ্রহ করেছেন।
রাজার ছিল ছয় রাণী, রাণীদের মনে সুখ নেই, থাকবে কী করে? এত বছর পার হয়ে গেল অথচ কোন রাণী সন্তানের মা হতে পারল না। এখন সারাদিনই হিরামন তোতাকে নিয়ে রাজার সময় কেটে যায়, রাণীদের মনে হিংসা, এই তোতা পাখিই রাজার সর্বনাশ ডেকে আনছে, একে তাড়াতে না পারলে ছয় রাণীর মনে শান্তি আসবে না, মনে মনে ছয় রাণী কু-মতলব আঁটতে লাগল
রাণীদের
সুযোগ এসে গেল, পাত্রমিত্রদের নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিল মহারাজ। পাঁচ-ছয় দিন জঙ্গলে
কেটে যাবে, তারপর শিকার শেষ করে মহারাজ ফিরবেন—এই সুযোগ রাণীরা হাতছাড়া করতে চায় না, যুক্তি করে ছয় রাণী
হিরামন তোতার খাঁচার কাছে গেলেন। হিরামন তোতা ছয় রাণীকে এক সাথে দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের
গুণকীর্তন করতে লাগলো, রাণীরা পাখির মুখে ভগবানের গুণকীর্তন শুনে বিভোর হয়ে পড়লেন।
হিরামনকে মারার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন, সেদিন আর হিরামনকে তাড়াতে পারলেন না। রাতে
ছয় রাণী মতলব আঁটলেন পরদিন হিরামনকে তাড়াবেন অথবা মেরে ফেলবেন। রাণীরা ঠিক করলেন
কাল আর হিরামনের মধুর স্বর শুনে কিছুতেই স্থির লক্ষ থেকে দূরে সরে যাবেন না।
পরদিন
আবার ছয় রাণী উপস্থিত হল হিরামনের সোনার খাঁচার সামনে। হিরামন ভগবানের নামে গান শুরু
করার আগেই হঠাৎ এক রাণী বলে বসল—'আচ্ছা হিরামন, মহারাজ তো
তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, বলে–তোমার মত বুদ্ধিমান আর একটিও
নেই, তা বলো তো হিরামন আমাদের ছয় রাণীর মধ্যে কে বেশি সুন্দরী আর কে বেশি কুৎসিত?’
বুদ্ধিমান
হিরামন রাণীদের কু-মতলব বুঝতে পেরে বলল—‘এই খাঁচার ভিতর থেকে তোমাদের
দেখে কী বলি বল তো? খাঁচা থেকে তোমাদের মুখ ভাল দেখতে পাচ্ছি না, এক কাজ কর, খাঁচার
মুখটা খুলে দাও, আমি বাইরে বেরিয়ে তোমাদের ভালভাবে দেখে বলে দেব কে বেশি সুন্দরী আর
কে বেশি কুৎসিত।'
ছয়
রাণী হিরামনকে মারার আগে একটু মজা করার জন্য বলল—'ঠিক আছে হিরামন তাই হবে, এই বলে ছয় রাণী ঘরের সমস্ত জানালা
বন্ধ করে দিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিলেন, হিরামন খাঁচার বাইরে বেরিয়ে দেওয়ালের মাথায়
ছোট্ট ঘুলঘুলিটা দেখে মনে মনে আশ্বস্ত হয়ে ভাবলো, দরজা জানালা বন্ধ করে কী হবে? আমি
আমার পালাবার পথ পেয়ে গেছি।'
—হিরামন বাইরে বেরিয়ে এলে রাণীরা বলল—‘এবার বলো তো হিরামন আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? আর কে কুৎসিত?’ হিরামন হিঃ হিঃ করে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল—‘ওগো ছয় রাণী গর্ব করার মত তোমাদের কারোরই সেই রূপ নেই, মহারাজ তোমাদের অনুগ্রহ করে গ্রহণ করেছে, রূপ যদি দেখতে হয় চলে যাও সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে সেই রাজ্যে, তার রূপের সুখ্যাতি কে না জানে, তোমরা তার পায়ের যোগ্য নও।' তবে রে বলে ছয় রাণী যেই হিরামনকে মারতে গেল, হিরামন ফুরুত করে সেই ঘুলঘুলি দিয়ে পালিয়ে গেল ।
মহারাজ
শিকার শেষে প্রাসাদে ফিরে হিরামনকে দেখতে না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। কোথায়
গেল তার হিরামন? চিৎকার করে চাকর-বাকরদের ধরে আনার আদেশ দিলেন প্রহরীদের। —কিন্তু তারা
জানবেই বা কী করে? রাজ়ার হুঙ্কারে তারা ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে বলল—‘মহারাজ আমরা কি করে জানব হিরামনের খবর।
আমরা ভুলে কখনও আপনার প্রাসাদের অন্দরে প্রবেশ করিনি।' ডেকে পাঠালেন রাণীদের, তারা
হিরামন নেই শুনে আকাশ থেকে পড়ল, মরাকান্না জুড়ে দিল । মহারাজ হিরামন বিরহে মনমরা
হয়ে পড়লেন। সর্বক্ষণ গালে হাত দিয়ে হিরামনের কথা ভাবেন, রাজ্য—রাজকার্য এমন কি নিজের খাওয়া দাওয়ার
ব্যাপারেও উদাসীন হয়ে পড়লেন।
মন্ত্রীদের
মাথায় হাত পড়ে গেল, মহারাজ এমন উদাসীন হয়ে পড়লে রাজকার্য দেখাশুনা করবে কে? শেষ
পর্যন্ত মন্ত্রীরা আলোচনা করে ঢোল পিটিয়ে রাজ্যের সর্বত্র জানিয়ে দিল, যে ব্যক্তি
মহারাজের হিরামন তোতা ফিরিয়ে দিতে পারবে তাকে পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কৃত করা হবে।
এদিকে হিরামন তোতা মন্ত্রীদের ঘোষণার কথা জানতে পারল। রাজপ্রাসাদের নিকটে এক কাঠুরের কুঁড়েঘর ছিল, সারাদিন কাঠ কেটে
অতি কষ্টে দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পাচ্ছিল, খুব গরীব ছিল কাঠুরে, হিরামন তোতা একদিন কাঠুরের
কুঁড়েঘরের সামনে গিয়ে বলল–ও কাঠুরে ভাই, আমি মহারাজের
হিরামন। তুমি কি পুরস্কারের ঘোষণা শুনেছ? আমাকে মহারাজের কাছে পৌঁছে দিলে পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
উপহার পাবে, দেখবে তোমার দুঃখ দূর হয়ে যাবে, আর কষ্ট করে কাঠ কাটতে হবে না।'
হিরামন
তোতার কথা শুনে বৃদ্ধ কাঠুরের চোখে জল এসে গেল, হিরামন তোতাকে নিয়ে গেল রাজার কাছে।
মহারাজ
তার হারানো হিরামনকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন, বৃদ্ধ কাঠুরেকে প্রতিশ্রুতি
মত পুরস্কার দিয়ে বিদায় করলেন।
তারপর
মহারাজ হিরামন তোতাকে একান্ত নিভৃতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন--'সোনা পাখী তুমি আমাকে ছেড়ে
কোথায় চলে গিয়েছিলেন?’
হিরামন
তোতা তখন মহারাজের ছয় রাণীর কু-মতলবের কথা বলল, আরো বলল—‘মহারাজ আপনার ঐ ছয় রাণী আসলে মানবী নয় রাক্ষসী, মন্ত্রবলে
আপনার সর্বনাশ করার জন্য ওরা মানবীর রূপ ধারণ করেছে।'
—হিরামন তোতার কথা শুনে মহারাজ
শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন—হিরামন তোতা মিথ্যা বলতে পারে
না, সঙ্গে সঙ্গে .মহারাজ তার বাগানে বিরাট এক গর্ত খুঁড়লেন, ছয় রাণীকে সেই গর্তে
জ্যান্ত ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিলেন, তারপর হিরামন তোতার কাছে এসে মহারাজ কৃতজ্ঞতার
স্বরে বললেন—'সোনা পাখি, বিপদে তুমিই আমার
প্রকৃত বন্ধু।'
রাণীদের
মাটি চাপা দেওয়ার পর মহারাজ মাঝে মাঝে উদাসীন হয়ে যেতেন, এমনি একদিন মহারাজ গালে
হাত দিয়ে সিংহাসনে বসে আছেন। হিরামন বলল-'মহারাজ আপনাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন?'
মহারাজ
বললেন...কিছুই ভাল লাগছে না হিরামন, সংসারে আমি এখন সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছি।'
--ও,
এই কথা, তার জন্য এত ভেঙ্গে পড়ার কী আছে? আপনার মনোমত মানুষ আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছি,
আমি নিয়ে আসব নতুন রাণীমাকে।
হিরামনের
কথায় মহারাজের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ব্যস্ত হয়ে বলল,—'কে সে হিরামন, কোথায় নিবাস
তার?'
—সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে,
আমি আপনাকে নিয়ে যাব সেই স্বর্ণকেশী গৌরবর্ণা রূপবতী রাজকন্যার কাছে, তবে একটা শর্ত
আছে?
-কী
শর্ত হিরামন? আমি যে কোন শর্তের জন্য তৈরি।
—মহারাজ আমার প্রথম প্রয়োজন
একটি পঙ্খীরাজ ঘোড়া, পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাব, এক্ষুণি
আমার একটা পঙ্খীরাজ ঘোড়া চাই।
মহারাজ
অবাক হয়ে বললেন—'পঙ্খীরাজ ঘোড়টি সে আমি কোথায়
পাব হিরামন? আমার আস্তাবলে অনেক ঘোড়া আছে তুমি তার মধ্যে যে কোন ঘোড়া বেছে নিতে পার।'
হিরামন বলল – “ঠিক আছে চলুন আস্তাবলে।' মহারাজ হিরামনকে নিয়ে আস্তাবলে গেল, হিরামন
সারি সারি ঘোড়া পরখ করে দেখে একটা ঘোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলল—'মহারাজ এই ঘোড়ায় করেই আমাদের যেতে
হবে, পঙ্খীরাজ এই একটাই আছে আপনার আস্তাবলে।'
হিরামনের
কথায় মহারাজ বিরক্ত হলেন, বললেন—'দিন দিন তোমার মতিভ্রম হচ্ছে
হিরামন, আস্তাবলে এত সুন্দর সুন্দর ঘোড়া থাকতে তুমি কিনা পছন্দ করলে একটা অর্ধমৃত
ঘোড়াকে, এখন দেখছি আমার ছয় রাণী ঠিকই বলেছে, পাখির কথা শুনে কাজ করলে একদিন বিপদে
পড়তে হবে। তোমার কথা শুনে আমার ছয় রাণীকে হত্যা করা উচিত হয়নি।'
মহারাজের
কথায় হিরামন তোতা একটুও বিচলিত হল না বরং সহজ গলায় বলল—‘মহারাজ আপনি আপনার শর্ত থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, আপনি কিন্তু
বলেছেন আমার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবেন, কোন সময়ই প্রতিবাদ করবেন না। আপনি যে ঘোড়াটিকে
অর্ধমৃত বলে তাচ্ছিল্য করছেন, এটাই আসলে পঙ্খীরাজ। অনাহারে অযত্নে এর চেহারা খারাপ
হয়েছে, এর জন্য দায়ী আপনার আস্তাবলের রক্ষকরা, মহারাজ কথায় আছে জহুরী রত্ন চিনতে
ভুল করে না, আপনি আমার কথা মেনে এই অর্ধমৃত ঘোড়াটিকে তিন মাস একটা নতুন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন
আস্তাবলে রাখুন এবং আপনি নিজে তত্ত্বাবধান করুন। দেখবেন তিন মাস পরে আপনি এই ঘোড়াকে
চিনতে পারবেন না।'
মহারাজের
মনে পড়ে গেল—'তাইতো হিরামনের সাথে শর্ত
হয়েছিল হিরামন যা বলবে মহারাজ তাই করবে।' মহারাজ অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল- 'আমারই ভুল হয়েছে
হিরামন, এখন থেকে তোমার কথা মত চলব। আর আজই এই ঘোড়ার জন্য আমি নতুন আস্তাবল তৈরি করাচ্ছি,
আর এর পরিচর্যার দায়িত্ব আমি নিলাম ।' তিন মাস মহারাজ দিনরাত ঐ ঘোড়ার যত্নআত্তি করলেন,
সময়মত দানা খাওয়ালেন, তাতে করে মহারাজ নিজেই অবাক হয়ে গেলেন, মনে মনে ভাবলেন হিরামন
ঠিকই বলেছে, বাস্তবিকই ঘোড়াটি অনেক উচ্চমানের । হিরামন তিন মাস পর ঘোড়া দেখে বলল—‘মহারাজ এবার ঘোড়া আমাদের সাত সমুদ্র
তেরো নদী পার করার উপযুক্ত হয়েছে।'
-এবার
আমার দরকার এক ঝুড়ি চাঁদির মটর। মহারাজ হিরামনের আদেশ মত এক ঝুড়ি চাঁদির মটর জোগান
দিলেন।
একদিন
প্রত্যুষে সূর্য ওঠার আগে হিরামন মহারাজের ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললেন, মহারাজ তৈরি হয়ে নিন,
আজ আমরা যাত্রা করব।
মহারাজ
হিরামনের আদেশ মত তৈরি হয়ে নিলেন, চাঁদির মটরের ঝুড়ি ঘোড়ার গলায় ঝুলিয়ে দিতে বলল
হিরামন। তারপর হিরামন বলল, ‘মহারাজ আপনি চাবুক নিয়ে ঘোড়ার
পিঠে উঠে বসুন, আমি আপনার কাঁধে বসছি। আর একটা কথা খুব মন দিয়ে শুনুন, ঘোড়ার গায়ে
একবার মাত্র চাবুক মেরে বলবেন—সত্যিই যদি তুমি পঙ্খীরাজ
ঘোড়া হও তবে আমাকে এক্ষুনি পৌছে দাও সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের সেই রূপবতী কন্যার
প্রাসাদে। দেখবেন মহারাজ একবারের বেশি কিন্তু চাবুক মারবেন না, তবে সব গণ্ডগোল হয়ে
যাবে।' হিরামনের কথামত মহারাজ ঘোড়ায় চেপে বসে—ঘোড়ার গায়ে কষিয়ে একবার চাবুক মেরে বললেন— ‘সত্যিই যদি তুমি পঙ্খীরাজ ঘোড়া হও তবে পৌছে দাও আমাদের সাত
সমুদ্র তেরো নদীর পারের সেই রূপবতী কন্যার প্রাসাদে।'
যেমনি
বলা অমনি পঙ্খীরাজ ঘোড়া মহারাজ ও হিরামনকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে উড়ে চলল আকাশ পথে,
কয়েক মুহুর্তের মধ্যে পেরিয়ে গেল সাত সমুদ্র তেরো নদী, মহারাজ এবং হিরামনকে নামিয়ে
দিল রাজপ্রাসাদের এক বটবৃক্ষের ছায়ায়।
বিকেল
গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল। হিরামনের পরামর্শ মত মহারাজ ঘোড়াটিকে বটবৃক্ষের নীচে বেঁধে
রেখে নিজে গাছে চড়ে বসলেন। হিরামন বলল—'মহারাজ আপাতত আপনার কাজ শেষ,
এবার আমার কাজ শুরু ।' এই বলে হিরামন ঝুড়ি থেকে একটি একটি করে চাঁদির মটর নিয়ে সুন্দরী
কন্যা যে ঘরে শুয়ে আছেন সেই ঘর থেকে বটবৃক্ষ পর্যন্ত ফেলে অভূতপূর্ব নক্সা তৈরি করল।
এই নক্সা করতে করতেই রাত কেটে গেল, ভোরবেলা রূপবতী কন্যার পরিচারিকা ঘরের দরজা খুলে
দেখে চাঁদির মটরদানা সারি সারি পড়ে আছে। দিনের আলোয় সেগুলো ঝলমল করছে, সঙ্গে সঙ্গে
ডেকে তুললেন রূপবতী কন্যাকে, রাজকন্যা প্রথমে বিশ্বাস করেনি, ঘরের বাইরে পা রেখে অবাক
হয়ে গেল। সত্যি সত্যিই চাঁদির মটর দানা পড়ে আছে, রাজকন্যা একটা একটা করে চাঁদির মটরদানা
তুলতে লাগল । মটরদানা তুলতে তুলতে একসময় পৌছে গেল বটবৃক্ষের কাছে, হিরামন সঙ্গে সঙ্গে
মহারাজের কানের সামনে মুখ নিয়ে বলল— ‘মহারাজ এই সুযোগে রাজকন্যাকে ঘোড়ার পিঠে
তুলে চাবুকের এক ঘা মেরে পঙ্খীরাজকে বলুন আপনার প্রাসাদে পৌছে দিতে! যেমন বলা তেমন
কাজ। মহারাজ এক লাফে গাছ থেকে নেমে রাজকন্যাকে তুলে নিলেন পঙ্খীরাজ ঘোড়ার পিঠে । চাবুকের
এক ঘা দিয়ে বললেন- ‘সত্যি যদি তুমি পঙ্খীরাজ হও তবে আমাদের খুব তাড়াতাড়ি প্রাসাদে
নিয়ে চল।”
হিরামন
মহারাজের কাঁধে চেপে বসল, পক্ষীরাজ সাঁই সাঁই করে আকাশের বুকে উঠে গেল, মহারাজ মনে
মনে হিরামনকে ধন্যবাদ দিতে লাগল, রাজকন্যা পেয়ে রাজার মনে দুর্বুদ্ধি জেগে উঠলো, মহারাজের
মনে হচ্ছিল পঙ্খীরাজ ঘোড়া খুব তাড়াতাড়ি চলছে না, সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার পঙ্খীরাজের
গায়ে চাবুকের আঘাত করলেন।
হিরামন
রাজার কাণ্ড দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে বলল—'এ কী করলেন মহারাজ! হিরামনের
কথা শেষ হওয়ার আগেই পঙ্খীরাজ ঘোড়া মহারাজকে নিয়ে মুখ থুবড়ে জঙ্গলে পড়ল। এ হেন
ঘটনায় মহারাজ হতবুদ্ধি হয়ে গেল, হিরামন হতাশ হয়ে বলল— “মহারাজ এবার তিন মাস এই গভীর জঙ্গলে অপেক্ষা করুন। আগের
মত এই ঘোড়ার যত্নআত্তি না করলে এ আর সুস্থ হয়ে চলাফেরা করতে পারবে না।'
মহারাজ
মাথায় হাত দিয়ে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য আফশোস করতে লাগল । এমন সময় একদল শিকারি
সেখানে উপস্থিত হল, তাদের মধ্যে আবার সেই দেশের রাজপুত্রও ছিল। রাজপুত্র এই গভীর জঙ্গলে
রূপবতী কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল, রাজকন্যার সামনে গিয়ে রাজপুত্র বলল- ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।'
মহারাজ
পাশে বসে একথা শুনতে পেয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, হুংকার দিয়ে বললেন- “কি! এত বড়
কথা? সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে তবে আমি এই রাজকন্যাকে নিয়ে এসেছি, আর তুমি বাবু
কোথাকার কে হে?
বীরদর্পে
রাজপুত্র বলল— আমি এই রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী
আর আমি যা বলি তাই করি। বিনা যুদ্ধে যদি তুমি এই সুন্দরী কন্যাকে আমার হাতে তুলে দিতে
না পার, তবে আমার সাথে যুদ্ধ কর।
মহারাজ
রাজপুত্রের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। শুরু হল যুদ্ধ, সে কি ভয়ানক যুদ্ধ! তাদের রণহুঙ্কারে
পশুপক্ষীরা পালাতে লাগল, রাজকন্যা পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখছিল আর মনে মনে ঈশ্বরের
কাছে প্রার্থনা করছিল, মহারাজ যেন জয়ী হয়, দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করার পর রাজপুত্র মহারাজের
কাছে হেরে যাচ্ছিল, রাজকন্যার মুখে হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু অতর্কিতেই ঘটে গেল ঘটনাটা।
রাজপুত্রের দুই অনুচর রাজপুত্রের পরাজয় দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল মহারাজার ওপর, মহারাজ তিনজনের
সাথে যুদ্ধ করে পারবে কী করে, একে তো দু'দিন অনাহারে কাটিয়েছেন। তারপর এতটা পথ অতিক্রম
করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মহারাজ হেরে গেলেন। রাজপুত্র মহারাজকে প্রাণে মারলেন না;
মহারাজের দুচোখ অন্ধ করে রাজপুত্র রাজকন্যাকে এবং পঙ্খীরাজ ঘোড়াটিকে নিয়ে প্রাসাদে
ফিরে গেল । প্রাসাদে ফিরে রাজপুত্র বলল—‘সুন্দরী আজই আমি তোমাকে বিয়ে
করতে চাই?’
রাজকন্যা
কিন্তু রাজাকেই বেশি পছন্দ করেছিল, কিন্তু একথা যদি রাজপুত্র জানতে পারে তবে হয়তো
রাজকন্যাকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করবে, বুদ্ধিমতী রাজকন্যা হেসে বলল—‘রাজপুত্র তোমার বীরত্বে আমি মুগ্ধ, তবে
এক বছরের মধ্যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি একটা ব্রত পালন করছি, শেষ হতে আর
মাত্র এক বছর বাকি আছে।' তারপর তোমাকে আমি বিয়ে করব। আর এই একটি বছর কোন পুরুষের মুখ
দর্শন করব না, ‘শুধুমাত্র এই অর্ধমৃত ঘোড়াটি আমার কাছে থাকবে।'
রাজপুত্র
রাজকন্যার রূপে এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে মনে মনে ভাবল একটি তো বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে—রাজকন্যার ইচ্ছে অনুসারে রাজপুত্র রাজকন্যার
জন্য আলাদা একটা প্রাসাদ তৈরি করে দিলেন, রাজকন্যা সেই প্রাসাদে পক্ষীরাজ ঘোড়াটিকে
সুস্থ করে তোলার জন্য যত্নআত্তি করতে লাগল, হিরামন তোতা তো বলেছেই তিন মাস সেবা করলে
পঙ্খীরাজ পুনরায় চলতে পারবে।
এক
এক করে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে, রাজকন্যা মহারাজের কথা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে পড়ছে। কোথায়
আছে মহারাজ আর হিরামনই বা কী করছে? রাজকন্যা প্রতিদিন বিকেলে প্রাসাদের ছাদে উঠে আকাশের
চারিদিকে হিরামনের খোঁজ করতো, ছাদের উপর বাটিতে করে পাখিদের খাবার রেখে দিত, যদি হিরামন
খাবারের সন্ধান করতে করতে এই প্রাসাদে আসে। এদিকে মহারাজকে নিয়ে জঙ্গলে হিরামন তোতা
পড়েছে মহা ফ্যাসাদে, সারাদিন ঘুরে ঘুরে হিরামন ফল সংগ্রহ করে মহারাজকে খেতে দেয়,
ঐ ছোট ছোট ফলে কি মহারাজের পেট ভরে? দিনে দিনে মহারাজের চেহারা ভেঙ্গে যাচ্ছে। একদিন
জঙ্গলের একদল পাখি হিরামনকে ডেকে বলল— 'হিরামন সারাদিন হন্যে হয়ে
ঘুরে ক’টা ফল পাবে? আমাদের সাথে গেলে
অনেক খাবার পাবে?
হিরামন
জিজ্ঞাসা করল— কোথায় যেতে হবে?
—এই রাজ্যের রাজপ্রাসাদে, প্রাসাদের
কাছেই একটা সুন্দর বাড়ি আছে, সেই বাড়ির রাজকন্যা প্রতিদিন সকাল বিকেল আমাদের জন্য
ছাদে খাবার রেখে দেয় । তুমি যাবে সেখানে?
হিরামন
রাজি হয়ে গেল, পরদিন সকালে অন্যান্য পাখিদের সাথে উপস্থিত হল সেই বাড়িতে, 'সত্যি
সত্যিই হিরামন দেখল বাড়ির ছাদে পাখিদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার রেখে দিয়েছে, হিরামন
ছাদের একপাশে সুন্দরী কন্যাকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠল, মনে মনে ভাবল—আরে এ যে সেই রাজকন্যা, সঙ্গে সঙ্গে হিরামন
রাজকন্যার কাছে গিয়ে বলল—“কি গো তুমি আমায় চিনতে পারছ?’
হিরামনের
গলা শুনে রাজকন্যা তাকাল, এর জন্যই তো রাজকন্যার প্রতীক্ষা, রাজকন্যা হিরামনকে হাতে
তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল—‘হিরামন মহারাজের খবর কী?’
মহারাজের
কথায় হিরামন বিষণ্ন সুরে বলল—'ভাল নেই রাজকন্যা, দিনে দিনে
শরীর ভেঙ্গে পড়ছে, খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে বললেই হয়।'
রাজকন্যা
হিরামনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল—‘এবার আমি যা বলব মন দিয়ে
শোন, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আমাদের প্রাসাদের পাশেই একটা বড় গাছ আছে, সেই গাছে
বাস করে এক বিহঙ্গম ও বিহঙ্গমী, তুমি তাদের বিষ্ঠা এনে যদি রাজার চোখে লাগিয়ে দিতে
পার, মহারাজ পুনরায় চোখ ফিরে পাবে।' রাজকন্যার পরামর্শ অনুযায়ী হিরামন সাত সমুদ্র
তেরো নদী পেরিয়ে বিহঙ্গম বিহঙ্গমীর তাজা বিষ্ঠা নিয়ে এসে চোখে দেওয়া মাত্র মহারাজের
চোখ ভাল হয়ে গেল। মহারাজ চোখ ফিরে পেয়ে হিরামন এবং রাজকন্যাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে
লাগলেন।
তারপর
মহারাজ হিরামনকে বলল—'হিরামন তোমার কথা না শুনে
আজ আমার এই দুর্দশা। এবার বলো আমি কি করব?'
হিরামন
মহারাজের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বুদ্ধি বাতলে দিল।
পরদিন
সকালে হিরামনের পরামর্শ অনুযায়ী মহারাজ নিজের রাজপোশাক ত্যাগ করে ছেঁড়া ময়লা কাপড়
পরে নিলেন।
চাকরের
পোশাকে সেজে মহারাজ গেলেন সেই সুন্দরী কন্যার প্রাসাদে, সুন্দরী কন্যা মহারাজকে দেখেই
চিনতে পেরেছিলো, মহারাজ রাজমাতার দর্শনপ্রার্থী হয়ে বললেন-
‘রাণীমা অনেক দিন না খেয়ে
আছি, যদি আপনার প্রাসাদে কাজের ব্যবস্থা হয় তবে দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পারব।'
রাজমাতার
মন ছিল খুব সাদাসিদে। তিনি বললেন—‘আহা বাছা না খেয়ে আছ, ঠিক
আছে আজ থেকে তুমি আমার প্রাসাদেরই ঘরদোর পরিষ্কার করো।
হিরামনের
পরিকল্পনা সফল হল, মহারাজের ওপর রাণীমা নির্দেশ দিলেন ভাবী পুত্রবধূকে দেখাশুনা করা
আর প্রাসাদের ঘরদোর পরিষ্কার করে রাখা।
এইভাবে
কিছুদিন কেটে গেল। একদিন হিরামন, মহারাজ এবং সুন্দরী কন্যাকে চুপি চুপি বলল— ‘মহারাজ পঙ্খীরাজ ঘোড়া সম্পূর্ণ সুস্থ।
আগামীকাল সূর্য ওঠার পূর্বে আমাদের এই প্রাসাদ ত্যাগ করতে হবে।'
পরদিন
ভোরে কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগে মহারাজ সুন্দরী কন্যাকে নিয়ে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে
ঘোড়াকে বললেন—‘তুমি যদি সত্যিকারের পঙ্খীরাজ
ঘোড়া হও তবে আমাদের প্রাসাদে পৌছে দাও।' এই বলে মহারাজ পঙ্খীরাজের গায়ে চাবুকের আঘাত
করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পঙ্খীরাজ রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে সাঁই সাঁই করে আকাশের বুকে মেঘের
আড়ালে ভেসে চললো।
সূর্য
ডোবার অনেক পূর্বেই মহারাজ সুন্দরী কন্যাকে নিয়ে পৌছে গেলেন নিজের প্রাসাদে। তারপর
শুভদিন দেখে রাজকন্যার সাথে মহারাজের বিয়ে হয়ে গেল, এবং বাকি জীবন মহারাজ সুন্দরী
রাজকন্যাকে নিয়ে সুখেই জীবন কাটাতে লাগল। একদিন মহারাজ হিরামন তোতাকে বলল—‘হিরামন আজ যা কিছু আমার হয়েছে, যা কিছু
পেয়েছি সবই তোমার অবদান, তাই তোমার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ তুমি জন্ম জন্মান্তর আমার
চিরসাথী হয়ে থেকো।'
Post a Comment
0 Comments